একদম সদ্য ক্রিকেট বুঝতে শুরু করা ক্ষুদে ক্রিকেটপ্রেমী যারা আছেন, যাদের সৌভাগ্য হয়নি শিবনারায়ণ চন্দরপলের ব্যাটিং স্ট্যান্স সরাসরি দেখার, তারা পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান ফাওয়াদ আলমের ব্যাটিং দেখে কিছুটা হলেও চোখের স্বস্তি পেতে পারেন। অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত! কারণ, দু'জনের ব্যাটিং স্ট্যান্সে শতভাগ মিল না থাকলেও অনেকাংশেই যে সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
ক্রিকেটীয় পরিবার থেকে উঠে আসা ফাওয়াদ আলমের পিতা তারিক আলম ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর নামকরা ক্রিকেটার। তার চাচা এবং মামাও ছিলেন প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ। ইংলিশ টেস্ট ক্রিকেটার উসমান আফজাল সম্পর্কে তার চাচাতো ভাই। ফাওয়াদ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন সাবেক পাকিস্তানি টেস্ট ক্রিকেটার মনসুর আক্তারের মেয়ের সঙ্গে।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বর্তমানে সিন্ধ প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এই পাক অলরাউন্ডারের পেশাদার ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে, পাকিস্তান কাস্টমস এর হয়ে খেলার সুবাদে। পাকিস্তান জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো তার ডাক পড়ে ২০০৭ সালে। ২০০৭ ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ভরাডুবির পর আসন্ন শ্রীলঙ্কা সফরের স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত হন ফাওয়াদ আলম, যথারীতি ওয়ানডে অভিষেকও ঘটে যায়। তবে রঙ্গিন পোশাকে অভিষেকটা একদমই বাজে হয় তার, গোল্ডেন ডাকের শিকার হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরত আসেন তিনি। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই অবশ্য ঘুরে দাঁড়ান তিনি। সে ম্যাচে ৩২ রানে অপরাজিত থেকে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন।
নির্বাচকরা ফাওয়াদের ক্রিকেটীয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ে তাকে ২০০৭ টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপের স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করে। সে আসরের সব ম্যাচে সুযোগ না মিললেও তিনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করার পর্যাপ্ত চেষ্টার ছাপ রাখতে সমর্থ হয়েছেন। সেমিফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানকে ফাইনালে পৌঁছাতে সাহায্য করেন, যদিও ফাইনাল ম্যাচের একাদশে তার ঠাঁই মিলেনি।
পাকিস্তানের রঙ্গিন জার্সিতে বছর দুয়েক খেলে ফেলার পর তার ডাক পড়ে সাদা পোশাকের রাজকীয় ফর্মেট টেস্ট ক্রিকেটে। ১২ জুলাই, ২০০৯। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো দেশের সাদা জার্সি গায়ে জড়িয়ে মাঠে নামেন ফাওয়াদ আলম। আর নেমেই ইতিহাস! হ্যা, প্রথম পাকিস্তানি ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্টেই বিদেশের মাটিতে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড সৃষ্টি করেন সেদিন। সে ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬৮ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলার পথে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ইউনিস খানের সঙ্গে ২০০ রানের রেকর্ড পার্টনারশিপ করেন। শুরুটা দারুণ হলেও মাত্র দুই মাচ পরেই অজানা কারণে তাকে দল থেকে ছাঁটাই করে ফেলা হয়। বঞ্চনার ইতিহাস শুরু সেখান থেকেই!
ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুরি ফুটিয়ে গেলেও জাতীয় দলে যেন দিন দিন ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছিলেন। ২০১০ সালের পর জাতীয় দলে ডাক পাওয়াটা যেন বহু প্রতিক্ষীত ছিল তার কাছে কিন্তু কোনভাবেই সুযোগ মিলছিলনা। অবশেষে শারজিল খানের ইঞ্জুরিতে ২০১৪ এশিয়া কাপে জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় তার। সুযোগসন্ধানী ফাওয়াদ সে আসরে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে পাকিস্তানকে ফাইনালে তোলার পেছনে অবদান রাখেন। ফাইনাল ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম এবং একমাত্র সেঞ্চুরি (১১৪*) করে দলের স্কোরকে সমৃদ্ধশালী করেন যদিও পাকিস্তান সে ম্যাচে বোলিং ব্যর্থতায় হেরে যায়। এশিয়া কাপের পর আস্তে আস্তে জাতীয় দলের দরজা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় তার জন্য।
প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট, লিস্ট 'এ', টি টুয়েন্টিসহ সব ধরণের ঘরোয়া ক্রিকেটেই রানবন্যা বইয়ে দিচ্ছিলেন কিন্তু পাকিস্তানের জার্সি আর গায়ে জড়ানো হচ্ছিলনা। ১৬৭ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ৩৪ টি সেঞ্চুরি ও ৬০ টি হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে ৫৬.৫২ গড়ে ১২,২৬৫ রান করার পরও মহসিন খান, ইনজামাম উল হক - কোন নির্বাচন প্যানেলের সুনজরে না পড়াটা রীতিমতো বিস্ময়করই বটে! উপরন্তু, রমিজ রাজা - ইনজামাম উল হকের মতো ক্রিকেটাররা যখন তার প্রতিভার ওপর 'ঘরোয়া ক্রিকেটার', 'জাতীয় দলে চলেনা' ধরণের তকমা সেঁটে দেয়, তখন তা যেন একপ্রকার মহা অবিচার - জুলুম হিসেবেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
কথায় আছে, মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারেনা। ফাওয়াদ আলম যেন সে কথারই বাস্তব প্রতিফলন। এত এত সমালোচনার মাঝেও নীরবে-নিভৃতে রানের ফোয়ারা ছড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সাল ২০২০। ২০০৯ সালের পর পাকিস্তান দল ততদিনে ৮৮ টি টেস্ট খেলে ফেলেছে। হঠাৎ নতুন কোচ মিসবাহ উল হক এবং ইউনিস খানের মনে ধরল তাকে, সুদীর্ঘ ১১ বছর পর পাকিস্তান টেস্ট দলে ফিরলেন ফাওয়াদ! করোনার মহামারীতে ক্রিকেট যেখানে থমকে গিয়েছিল গোটাবিশ্বে, তারমধ্যেই ইংলিশ সয়েলের কঠিন কন্ডিশনে ব্যাট হাতে সুদীর্ঘ ১১ বছর পর নামতে হয়েছিল ফাওয়াদকে। দীর্ঘ বিরতি শেষে সাউদাম্পটন টেস্টে যখন প্রথম ইনিংসে ক্রিস ওকসের বলে এলবিডব্লুর শিকার হয়ে সাজঘরে ফিরলেন, তখনও চারদিকে রব উঠেছিল, "ফাওয়াদের ব্যাটিংয়ের স্টাইল নেই, টেম্পারমেন্ট নেই, এই টেকনিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চলেনা... ইত্যাদি"।
ফাওয়াদ দমে গেলেন না। নিজের জাত চেনানোর জন্য বেছে নিলেন কঠিন সময়কে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে বৈরি কন্ডিশনে শেষদিনে পাকিস্তানের জয়ের জন্য দরকার ৩০২ রান, হাতে ৭ উইকেট। এমন চাপের মূহুর্তেই তিনি করে বসলেন তার টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। ধৈর্য্য, বঞ্চনা, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ - সবকিছু মিলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি সেদিন যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, তা এককথায় অনবদ্য। বলা বাহুল্য, টেস্টে তার ব্যাটে এই দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি আসে ৪,২১৮ দিন পর, যা টেস্ট ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ বিরতির পর সেঞ্চুরির রেকর্ড।
সদ্য সমাপ্ত করাচি টেস্টে ২৭ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান যখন রীতিমতো ধুঁকছে, ফলো অন যখন চোখ রাঙাচ্ছে, তখনও ঠিকই ত্রাতা হয়ে এসেছেন ফাওয়াদ আলম। অনবদ্য সেঞ্চুরি করে দলকে শুধু খাদের কিনারা থেকে টেনেই তুলেননি, সম্মানজনক লিডও এনে দিয়েছেন। ফলাফল পাকিস্তানের টেস্ট জয়। মজার বিষয় হচ্ছে, ফাওয়াদ আলমের টেস্ট ক্যারিয়ারে তিনটি শক্তকের বিপরীতে অর্ধশতকের সংখ্যা শূন্য। কারণ, প্রতিটি অর্ধশতককেই যে তিনি শতকে রূপদান করেছেন! তৃতীয় শতকটি করার পর তিনি দুই হাতের মোট দশটি আঙ্গুল তুলে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, তার জীবনের দশটি বছরের অপার সম্ভাবনার অপমৃত্যু কি ফিরিয়ে দেবেন নির্বাচকরা, যে সম্ভাবনাকে তারা অবহেলায় গলা টিপে হত্যা করেছিলেন?
৩৫ বছর বয়সী এ ব্যাটসম্যান হয়তো আরো বছর কয়েক খেলবেন ক্রিকেট। এরপর একসময় ব্যাট-প্যাড তুলে অবসরে চলে যাবেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হয়তো আহামরি কোন পরিসংখ্যান রেখে যেতে পারবেননা, কিন্তু একটি বার্তা হয়তো ঠিকই রেখে যাবেন। আর সেটি হচ্ছে, কখনো হাল ছাড়তে নেই, সৃষ্টিকর্তা হয়তো জীবনের কোন এক সময় রাজসিক প্রত্যাবর্তনের মঞ্চে ঠিকই তোমাকে উদ্ভাসিত বিজয় দান করবেন। দিনশেষে ক্রিকেট সাধারণ একটি খেলা হলেও ফাওয়াদদের জীবনে ক্রিকেট মিশে যায় জীবন সংগ্রামে। শত প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রতিনিয়ত চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় হার না মানা একেকটি ইনিংস যেন হয়ে ওঠে তাদের প্রতিবাদের ভাষা, একেকটি নীরব প্রতিবাদ। ভাল থাকুক ফাওয়াদ আলমরা।