মুহাম্মদ আশিক সৈকতঃ বাংলাদেশ ক্রিকেটে গত বারো বছরে তামিম ইকবালের সঙ্গে ওপেনিং জুটিতে ডজন খানেকের অধিক ক্রিকেটারকে ইনিংস ওপেন করতে দেখা গেলেও বেশ কয়েকটি দুর্দান্ত পার্টনারশিপে তামিমের যোগ্য সঙ্গী হিসেবে প্রথমদিকে যার নাম থাকবে, তিনি ইমরুল কায়েস। মাশরাফি ব্যতীত পঞ্চপাণ্ডবের বাকি চার সদস্যের উত্থানের প্রায় সমসাময়িক কালেই জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে ইমরুলের, ২০০৮ সালে। অথচ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রায় একযুগ কাটিয়ে ফেললেও এখনও জাতীয় দলে তার জায়গা পাকাপোক্ত নয়, এমনকি পরবর্তী সিরিজে ডাক পাবেন কিনা সেটা নিয়েও হরহামেশাই ধোঁয়াশার ভেতর কাটাতে হয়।
ক্রিকেটার হিসেবে ইমরুল যে খুব খারাপ মানের - এ কথা কস্মিনকালেও বলার সুযোগ নেই, অন্তত পরিসংখ্যান কিন্তু সেটাই বলে। ইমরুলকে যুক্তির খাতিরে কিছুটা অধারাবাহিক বলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ দলের বাকি ওপেনাররা যে খুব ধারাবাহিক, সেটাও কিন্তু নয়। বরং ওপেনিং জুটিতে তামিমের সাথে তার বোঝাপড়াই সবথেকে ভাল, যার প্রমাণ বহুবার মাঠে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবুও অজানা কারণে নির্বাচকদের পছন্দের তালিকায় কদাচিৎ ঠাঁই মেলে তার!
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০০৬ সালে অভিষেকের মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে দিয়ে ২১ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা রাখেন ইমরুল। সে বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন তিনি। শুরুটা নিষ্প্রভ হলেও নিজেকে প্রমাণ করতে বেশি সময় লাগেনি তার। ২০১০ সালে ওয়ানডেতে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে ৮৬৭ রান করেছিলেন, যা সেবছর সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারীর তালিকায় ৫ম স্থানে ছিল!
ইমরুলের এহেন পারফরম্যান্স তাকে জায়গা করে দেয় ২০১১ বিশ্বকাপের মূল দলে। সে আসরে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের বাঁধা টপকাতে না পারলেও ইমরুল ছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী (৩৭.৬০ গড়ে ১৮৮ রান), দুটো ম্যাচে 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' এওয়ার্ডও ঝুলিতে পুড়েন তিনি। সেবছর অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল থাকা সত্ত্বেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচকরা যেন তার কাঁধের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। পরবর্তী সময়গুলোতে দলে সর্বদা আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকতেন। অথচ তার এই আসা যাওয়ার পেছনে মূল সমস্যাটা কোথায় কিংবা কোন ভুলগুলো নিয়ে তাকে কাজ করতে হবে, নির্বাচকমণ্ডলী কখনোই তা খোলাসা করার প্রয়োজনবোধ করেনি!
হুটহাট দলে ডাক পাওয়াটা যেন ইমরুলের জন্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, এ নিয়ে মানসিক প্রস্তুতিরও কমতি নেই তার। একবার এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, " সবসময় একটা লাগেজ আলাদা করে গোছানোই থাকে বাংলাদেশ দলের জন্য। আমি যেখানেই থাকি না কেন, যেন আমার কেয়ার টেকার সেটা সহজেই পাঠিয়ে দিতে পারে।" এই হলেন আমাদের ইমরুল কায়েস! অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দলে আসা যাওয়ার মধ্যে থেকে পারফর্ম করে যাওয়াটা যে কিরূপ কষ্টসাধ্য, তা কখনোই বলার অপেক্ষা রাখেনা।
২০১৫ সালে খুলনা টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওপেনিং জুটিতে তামিমের সাথে ৩৫০+ রানের দুর্দান্ত পার্টনারশিপটি গড়েছিলেন রীতিমতো নিজের সাথে সংগ্রাম করে। কারণ, সে টেস্টেই মুশফিকের ইঞ্জুরিতে জীবনে প্রথমবারের মতো উইকেটকিপারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এমনিতেই অস্বাভাবিক ঘামেন বলে মাসল ক্র্যাম্প বেশি হয়। তার ওপর টানা ১৫০ ওভার উইকেটকিপিং করে তীব্র পানিশূন্যতায় অজ্ঞান হতে বসেছিলেন! এমন অবস্থায় ওপেনিং এ নেমে ১৫০ রান করাটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। বিপিএল ফাইনালেও ক্র্যাম্প নিয়ে ব্যাটিং চালিয়ে কুমিল্লাকে জিতিয়ে তবেই ফিরেছিলেন তিনি। এর বছর দুয়েক পরে ওয়েলিংটন টেস্টেও মুশফিকের ইঞ্জুরিতে উইকেটকিপারের গ্লাভসজোড়া হাতে তুলে নিয়েছিলেন ইমরুল কায়েস। সে যাত্রায় তো রীতিমতো বিশ্বরেকর্ড গড়েন তিনি। বিশ্বের প্রথম বদলি উইকেটকিপার হিসেবে এক ইনিংসে পাঁচটি ক্যাচ নেওয়ার দূর্লভ রেকর্ডের মালিক বনে যান তিনি! এতকিছুর পরও ওপেনিং এ নামতে হয় সেই ইমরুলকেই। শরীরের সকল সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে দলের স্বার্থে নিজেকে নিবেদিতভাবে মেলে ধরার সাহসিকতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
ইমরুলকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের 'অপ্রশংসিত নায়ক' বললেও ভুল হবেনা হয়তো। তার খেলা নান্দনিক ইনিংস অন্য কারো পারফরম্যান্সের ছায়ার ঢাকা পড়ে গেছে, এমন উদাহরণ ভূড়ি ভূড়ি। ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সর্বমোট করেছিলেন ৩৪৯ রান, ইনিংসগুলো ছিল যথাক্রমে ১৪৪, ৯০ ও ১১৫ রানের! ক্রিকেটবিশ্বে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন কেবল বাবর আজম (৩৬০ রান)। অথচ এমন দারুণ পারফরম্যান্স এর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুযোগ পেলেন প্রথম দুই ওয়ানডেতে। আর পরবর্তী নিউজিল্যান্ড সফরে তো সুযোগই মিললোনা অথচ সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান ছিল তার (৩ ওয়ানডেতে ১১৫ রান)!
তার সমকালীন ক্রিকেটারদের মধ্যে তামিম, মুশফিক, রিয়াদ, সাকিবরা দেশের জার্সিতে সব ফর্ম্যাটে প্রায় তিনশ' খানেক ম্যাচ খেলে ফেললেও ইমরুলের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা দেড়শোর কাঁটাও স্পর্শ করেনি। বারবার উপেক্ষিত ইমরুল কায়েসকে এত বছর পরও একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতে হয় নির্বাচকমণ্ডলীর দিকে, যা খুবই হতাশাজনক। নিয়মিত সুযোগ পেলে তার পরিসংখ্যানও যে তামিম মুশফিকের মতো সমৃদ্ধশালী হতে পারতো, সেটা ভাবতে গেলে অনুমিতই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের 'পোস্টার বয়' এর তকমাও জুটতে পারতো তার। অথচ এর পরিবর্তে তার কপালে জোটে নিদারুণ অবহেলা আর উপহাস!
মধ্যযুগের বিখ্যাত আরব্য কবি ইমরুল কায়েসের সঙ্গে নামের মিল থাকলেও তার মতো বেপরোয়া-বিতর্কিত জীবনযাপন থেকে একেবারে আলাদা ২২ গজের আমাদের ইমরুল কায়েস। ব্যক্তিজীবনে খুব নরম সরম বলেই হয়তো তার সাথে নির্বাচকমণ্ডলীর করা এই অবিচারের গ্লানি নীরবেই বয়ে বেড়ান তিনি। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই অবহেলিত,নিবেদিত, নিপাট ভদ্র মানুষটাকে নিয়ে এক শ্রেণির নিকৃষ্ট মানুষকে যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ট্রল করতে দেখি, তখন বেশ অবাকই হতে হয়। নিজের অজান্তেই মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেও কি ক্রিকেট কিংবা ক্রিকেটারদের ত্যাগের মর্ম বোঝেন তারা? হয়তো বোঝেন না। আর বোঝেন না বলেই ইমরুলের সংগ্রামের গল্পগুলি তার পারফরম্যান্স এর মতোই হারিয়ে যায় হাজার হাজার ট্রল আর ব্যাঙ্গাত্মকভাবে 'ব্রো' ডাকের ভীড়ে।
মাঝেমাঝে অস্ফুটস্বরে আপনা আপনিই মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, আমরা মানসিকভাবে 'মানুষ' হতে পারবো তো?