১৯৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। রুম নম্বর ৭০৭, হোটেল পূর্বাণী। ওপেনার রকিবুল হাসান বসে বসে ভাবছেন আগামীকালের ম্যাচে সুযোগ পাবেন কিনা। উল্লেখ্য, ঢাকায় সেসময় খেলতে এসেছিল 'কমনওয়েলথ একাদশ' নামের একটি দল, যে দলের অধিনায়ক ছিলেন বিখ্যাত ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যালেক স্টুয়ার্ট এর বাবা মিকি স্টুয়ার্ট। পাকিস্তান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের নির্বাচিত একাদশের বিরুদ্ধে প্রথম বেসরকারি টেস্টের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। ওপেনার রকিবুল হাসান সে ম্যাচ নিয়েই ভাবনার চিন্তায় ডুবে ছিলেন।
ভাবনার দুয়ারে ছেদ ঘটাতে হঠাৎ রুমে আসলেন দলের ম্যানেজার মি. ইরতেজা। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ব্লেজার, নতুন ব্যাট-প্যাড-গ্লাভস দিয়ে রকিবুলকে বললেন, "রকিবুল, কাল তুমি আজমত রানার সাথে ইনিংস ওপেন করবে৷ প্রস্তুত থাকো।" স্বপ্ন তাহলে সত্যি হতে যাচ্ছে! জহির আব্বাস, ওয়াসিম বারি, ইন্তিখাব আলম, সরফরাজ নেওয়াজ, মুশতাক মোহাম্মদদের সাথে একমাত্র বাঙ্গালি হিসেবে একই দলে খেলবেন ১৮ বছরের তরুণ রকিবুল হাসান, এটা ভেবেই যেন শিহরণের দোল খেলে গেল তার হৃদয়জুড়ে।
সেদিন রাতে রকিবুলের দলে অন্তর্ভুক্তির খবর শুনে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন বঙ্গবন্ধুপুত্র বিশিষ্ট ক্রীড়াপ্রেমিক শেখ কামাল, সঙ্গে আরও আসেন ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ৭০৭ নম্বর রুমে আড্ডার এক পর্যায়ে নতুন 'গান এন্ড মুর' ব্যাটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় রকিবুলের মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে যায় - এই ব্যাটে 'জয় বাংলা' স্লোগান লেখা স্টিকার লাগিয়ে মাঠে নামলে কেমন হয়! উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেসময় 'জয় বাংলা' স্লোগান সম্বলিত তিনকোনা স্টিকার বের করে, যা অনেকেই গাড়িতে লাগিয়ে ঘুরতো। বিষয়টা শেখ কামালকে জানাতেই তিনি নড়েচড়ে বসলেন। তড়িঘড়ি করে মোস্তফা জালালকে আওয়ামী লীগ অফিসে পাঠালেন স্টিকার আনতে। স্টিকার আনা হলে শেখ কামাল নিজ হাতে তা রকিবুল হাসানের ব্যাটে লাগিয়ে দেন। এই স্টিকার লাগানোর আরেকটি কারণ আছে। পাকিস্তান একাদশের খেলোয়াড়দের দেওয়া ব্যাটে ছিল আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক 'তলোয়ার' এর চিহ্ন। কিন্তু, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক তো নৌকা - এটা ভেবেই রকিবুল হাসান সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। সকাল ১০ টা। টস জিতে ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান একাদশ। আজমত রানার সঙ্গে ওপেনিংয়ে নামলেন রকিবুল হাসান। হঠাৎ স্টিল ক্যামেরার নজর কাড়লো রকিবুলের ব্যাট। এর কিছুক্ষণ পরই মাঠের ১৫ হাজার দর্শকের আর বুঝতে বাকি রইলনা যে ঘটনা আসলে কি! মুহুর্তেই 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে পুরো স্টেডিয়াম মুখরিত হয়ে উঠলো।
প্রথম ইনিংসে মাত্র একরান করে প্যাভিলিয়নে ফিরে এলেও পাকিস্তানসহ বিশ্বমিডিয়ায় যে তিনি বিরাট সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ১ম দিন লাঞ্চ ব্রেকে ড্রেসিংরুমে বসে স্যুপ খাচ্ছিলেন রকিবুল, হঠাৎই ব্যস্ততার সাথে ছুটে এসে রকিবুলের সামনে বসে পড়লেন দলের ম্যানেজার মি. ইরতেজা। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, "এই স্টিকারে কি লেখা আছে?" রকিবুলের নির্বিকার উত্তর, "জয় বাংলা।" " হোয়াট ইজ দ্য মিনিং অব 'জয় বাংলা?" "'জয় বাংলা' মিনস ইস্ট পাকিস্তান জিন্দাবাদ।" মি. ইরতেজা শান্ত প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি বললেন, "তুমি এই মুহূর্তে গোটা পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করছো। আমরা সবাই পাকিস্তানি। আলাদা করে বাংলার বিজয় কামনা করাটা বিদঘুটে হয়ে গেল না!" রকিবুল নিশ্চুপ রইলেন। উত্তর না পেয়ে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ রকিবুলের দিকে তাকিয়ে মি. ইরতেজা উঠে চলে গেলেন।
বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই 'জয় বাংলা' স্টিকার নিয়ে বাকি পাক খেলোয়াড়দের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। জহির আব্বাস, মুশতাক মোহাম্মদ, ওসাসিম বারিরা বরং রীতিমতো রসিকতা শুরু করে দিয়েছিল ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে। কারণ, তারাও বেশ কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিল ইয়াহিয়া খান এবং সেনাবাহিনীর বৈরি আচরণে।
১ মার্চ ছিল টেস্ট ম্যাচটির চতুর্থ ও শেষদিন। সেদিন দুপুরে খবর আসলো, আসন্ন ৩ তারিখের এসেম্বলি ভুট্টোর পরামর্শে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাতিল ঘোষণা করেছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই মাঠের দর্শকরা প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিলো। স্টেডিয়ামে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে নিরাপদে নিয়ে আসা হলো। তাদের বলা হলো, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর গাড়ি আসবে এবং খেলোয়াড়দের নিরাপদে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। হঠাৎ, রকিবুলের মনে হলো ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া তার জন্য নিরাপদ নয়। তাই, তিনি তৎক্ষণাৎ ম্যানেজারকে বুঝিয়ে মুচলেকা দিয়ে ক্রিকেটের পোশাক খুলে সাধারণ পোশাকে হোটেল পূর্বাণীতে ফেরেন। ৪ মার্চ পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা নিজ দেশে ফিরে যান।
ঢাকা ছাড়ার আগে জহির আব্বাস রকিবুলের সাথে দেখা করে বলেছিলেন, "করাচিতে দেখা হবে।" উল্লেখ্য, সেসময় আসন্ন মে মাসে পাকিস্তান দলের ইংল্যান্ড সফর করার কথা ছিল। জহির আব্বাসের সঙ্গে রকিবুল হাসানের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, উক্ত সফরে রকিবুল পাকিস্তান দলে তাদের সঙ্গে থাকবেন। মজার ব্যাপার, সে সফরের পাকিস্তান স্কোয়াডে রকিবুলের নামও এসেছিল, খেলার জন্য কাগজপত্রও রেডি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, রকিবুল যাননি! ঢাকা থেকে জহির আব্বাসকে বিদায় দেওয়ার সময় তিনি কি বলেছিলেন, জানেন? জহির আব্বাসের "করাচিতে দেখা হবে"- কথাটা শুনে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, "নিশ্চয়ই পরেরবার দেখা হবে। কিন্তু, সেসময় আমার হাতে নতুন পাসপোর্ট থাকবে।"
রকিবুল কথা রেখেছিলেন। ইংল্যান্ড সফরের পাকিস্তান দলে ডাক পেয়েও তা ফিরিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রহাতে দেশকে স্বাধীন করে তবেই বাড়ি ফেরেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসংখ্যবার জহির আব্বাসের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, প্রায়সময়ই জহির তাকে বলতেন, "ছোটু, তুই দেশ স্বাধীন হওয়ার ব্যাপারে এত আত্মবিশ্বাসী কিভাবে ছিলি, তা এখনও আমার মাথায় আসেনা!" শুনে রকিবুল সর্বদাই স্মিত হাসতেন।
রকিবুল হাসানদের এই স্মিতহাস্যের পেছনে অনেক সাহসিকতার ইতিহাস লুকিয়ে থাকে। একটা তথ্য দিতে ভুলে গিয়েছি। সেটা হচ্ছে- 'জয় বাংলা' স্টিকার লাগানোয় দেশাদ্রোহিতার অপরাধে রকিবুল হাসানকে হত্যার আদেশ পর্যন্ত জারি করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে তা আর বাস্তবায়িত হতে দেওয়া হয়নি। রকিবুল হাসানদের মতো কিংবদন্তিরা অকুতোভয় ছিলেন বলেই আমরা আজ স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারছি, মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করা সম্ভব হচ্ছে।
কে বলেছে, ক্রিকেট শুধু মাঠের খেলা বা বিনোদন, এটি তো প্রতিবাদের ভাষা জানানোর উপযুক্ত মঞ্চও বটে! স্যালুট, কিংবদন্তি রকিবুল হাসান!